মায়ের ভালোবাসা

 মায়ের ভালোবাসা 


মায়ের মৃত্যুর এক বছরের মধ্যে বিল্টুর বাবা যখন আবার বিয়ে করে ঘরে বৌ আনলো,মায়ের ভালোবাসা  পাড়ার লোক অনেক কথা বলেছিল সেদিন।

-"বৌ মরার বছর ঘুরতে না ঘুরতে বিয়ে? তাও এমন বিধবা কালো কুচকুচে মেয়েকে!"

বিল্টুর বাবা গোপাল‌ সেদিন কারো কথার উত্তর দেয়নি। ছোট্ট বিল্টুর যে মায়ের খুব দরকার সেটা সে বুঝেছিল, সারাদিন ছেলেটা কাঁদে। গোপাল কাজে বেরিয়ে যায় সাত সকালে। অসুস্থ মা একা পারে না দূরন্ত বিল্টুকে সামলাতে।

মায়ের ভালোবাসা

চম্পা এক অভাগী মেয়ে, ছোট বেলায় বাপ মা হারা  সে, মামার বাড়ি মানুষ। বিয়ের তিনমাসের মধ্যেই বিধবা হয়ে ফিরে আসে মামার সংসারে। সবাই বলেছিল-"কি কুলটা মেয়ে বাবা? একে তো ওই রূপের ছিরি,বিয়ে হতে না হতেই বর কে খেলো!" সারাদিন কাঁদতো চম্পা।মামা মামীর গঞ্জনা সহ্য করতে হতো তাকে প্রতিনিয়ত। তাই গোপালের সাথে দ্বিতীয় বার বিয়ে দিয়ে ঘাড় থেকে বোঝা নামিয়ে যেনো শান্তি পেয়েছিল চম্পার মামা মামী।


চম্পাও স্বপ্ন দেখেছিল নতুন করে সংসার করার। এ বাড়িতে এসেই কোলে তুলে নিয়েছিল ছোট্ট বিল্টুকে। সারাদিন বাড়ির সব কাজ করে বিল্টুকে সামলাতো চম্পা। বিল্টু খুব দূরন্ত, কিন্তু আশেপাশের লোকজন যখন শাশুড়ি মায়ের কাছে এসে বলতো-"দেখো খুড়ি বিল্টুকে নিয়ে বড় ভয় হয় সৎ মা তো, যদি কোনো ক্ষতি করে দেয় তখন!"

এসব শুনে চোখে জল আসতো চম্পার। কিন্তু বিল্টুর মুখে যখন আধো আধো গলায় মা ডাকটা শুনতো সে,  মনটা যেনো জুড়িয়ে যেতো ভুলে যেতো সে সব অপমান, যন্ত্রণা।

মায়ের ভালোবাসা

বিল্টুকে মনের মতো করে মানুষ করার স্বপ্ন দেখতো চম্পা। সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছিল বিল্টুই হবে তার একমাত্র সন্তান। কিন্তু হঠাৎ ঘটে গেল অঘটন। একটা ভয়াবহ দুর্ঘটনার মারা গেল গোপাল। পাড়ার লোক বললো-"ডাইনি একটা, যার সাথে বিয়ে হয় তাকেই খায়‌।"

শাশুড়িও একমাত্র ছেলের মৃত্যু শোকে কথা শোনাতে ছাড়লো না। গোপালের মৃতদেহের সামনে ঠায় বসেছিল চম্পা। হঠাৎ আঁচলে টান পড়তেই দেখলো বিল্টু। চম্পা বিল্টুকে কোলে করে ঘরে নিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে এলো। সংসারের দুর্দিন নেমে এলো।চরম অভাবের সম্মুখীন হল গোটা পরিবার। অসুস্থ শাশুড়ি মাকেও বাঁচানো গেল না বেশীদিন, ছেলের শোকে তিনিও শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। চারপাশে লোকজনের অপমান সহ্য করতে না পেরে চম্পার মনে হতো মাঝে মাঝে, দূরে কোথাও চলে যায় কিন্তু ওই কচি মুখটার দিকে তাকিয়ে কোথাও যেতে পারেনি সে।

মায়ের ভালোবাসা

ছেলে দুষ্টুমি করলে একটু বকলেই লোক বলে-'সৎ মা তো স্বাভাবিক ব্যাপার।"

চম্পা বুঝতে পারতো না যে কোন মা তার সন্তানকে শাসন করে না? চম্পা মনে মনে ঠিক করে নিল বিল্টুকে ফেলে সে যখন বাঁচতে পারবে না,তখন বিল্টুকে সবার চোখের বাইরে নিজের মতো করে নিয়ে বাঁচবে। যেখানে কেউ জানবে না, সে বিল্টুর সৎ মা। চম্পা তার বান্ধবী পারুল কে বললো -"তুই তো শহরে কাজ করিস আমার একটা কাজ দেখে দে ভাই। নাহলে না খেতে পেয়ে যে আমি আর ছেলেটা মরে যাবো।"

পারুল বললো-"ঠিক আছে তুই আমার সাথে চল একটা বাড়িতে কাজের লোক দরকার,আমার চেনা।"


চম্পা শহরে গেল পারুলের সাথে বিল্টুকে কোলে নিয়ে। গিয়ে কথা বললো সে বাড়ির মালকিন দোয়েল বোসের সাথে। দোয়েল বোস একজন সিঙ্গেল মাদার।ছেলেকে নিয়ে তার সংসার। বাচ্ছাটাকে সারাদিন দেখার জন্য একজন লোক দরকার, আগের মেয়েটি কাজ ছেড়ে দিয়েছে তাই। সারাদিন অফিসে ব্যস্ত থাকেন দোয়েল। চম্পা তার জীবনের সব কিছু বললো। দোয়েল বোঝে একটা মা বা একটা মেয়ের যন্ত্রণা। বললো-"দেখো এ বাড়িতে আমি একাই থাকি ছেলেকে নিয়ে। তুমি চাইলে তোমার ছেলেকে নিয়ে থেকে কাজ করতে পারো।"

মাইনের কথা বলতেই চম্পা বললো-"না ম্যাডাম কোনো টাকা আমার লাগবে না শুধু আমার ছেলেটাকে লেখাপড়া শেখাতে চাই।"

ছোট্ট বিল্টুর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলেন কি মায়া ভরা মুখ। বললেন-"ঠিক আছে তাই হবে। তোমাকে বিশ্বাস করে বাড়িতে রাখছি বিশ্বাস টা রেখো।"

চম্পা বলে-"আপনার এই সাহায্য আমি কখনো ভুলবো না।"


কয়েকদিন পর যা ছিল জামাকাপড় দরকারি জিনিসপত্র পুঁটলি বেঁধে বিল্টুকে নিয়ে রওনা দিল শহরের দিকে। অনেকেই  বললো-"বাচ্ছা টাকে নিশ্চয়ই বেচে খাবে হতভাগী।" কেউ কেউ আটকাতে চাইলো। চম্পা বললো -"তোমরা তাহলে নাও বিল্টুর দায়িত্ব। আমার ছেলেটা যখন খিদেয় ছটফট করে তখন কি তোমরা দুটো খাবার মুখে দাও? তাহলে আমার ছেলেকে নিয়ে আমি কোথায় যাবো তা জানার অধিকার তোমাদের নেই।"


চম্পা থেকে গেলো দোয়েল বোসের পরিবারে। দোয়েল বোসের ছেলে আদিত্যর তো ভাইকে ছাড়া চলে না।একসাথে পড়ে, খেলে,খায়। দোয়েল দেবী স্বস্তি পেয়েছেন। বিল্টু আর আদিত্যকে নিয়ে পড়তে বসান অফিস থেকে ফিরে। আর চম্পা ব্যস্ত থাকে রান্নার কাজে। বিল্টু দুষ্টু হলেও পড়াশোনায় খুব মনোযোগী।বিল্টু একটু বড় হতেই বিল্টুকেও ভর্তি করে দিলেন আদিত্যর স্কুলে। দু ভাই হাত ধরে যখন স্কুলে যায় চম্পা আপন মনে তাকিয়ে থাকে সে দিকে কতো স্বপ্ন তার ছেলেটাকে নিয়ে।


আদিত্য বিল্টু দুজন বেশ ভালো ভাবে উত্তীর্ণ হতে হতে এগিয়ে যেতে থাকলো লেখাপড়ায়। চম্পা,দোয়েল দেবীর বয়স হচ্ছে। দুই ছেলেই বড় হয়েছে। আদিত্য ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র এখন হোস্টেলে থাকে‌।দাদাকে ছাড়া একা একা বাড়িতে ভালো লাগে না ওর।দোয়েল আন্টি ওকে সবসময় বোঝায়-"ভালো রেজাল্ট করতে হবে বিল্টু। মাকে দেখতে তো হবে তোকে।"

বিল্টু উচ্চমাধ্যমিকে রীতিমত ভালো রেজাল্ট করে ডাক্তারি পড়তে চলে গেল হোস্টেলে। সবাই বললো এ বাড়ির দুই ছেলেই রত্ন। বাড়ি ফাঁকা এখন, বড় একা লাগে এখন দুই মায়েরই।


বছর পাঁচেক কেটে গেছে। দোয়েল দেবী চম্পাকে বলে দিয়েছেন-"যে কটা দিন বাঁচবো দুই মা একসাথে ছেলেদের নিয়ে থাকবো। কখনো কোথাও যেতে হবে না তোমার।"

একদিন বিল্টু এসে বললো-"মা এবার ক্যাম্প হচ্ছে একটা গ্ৰামে। বুঝলে মা ওই গ্ৰামে কোনো হাসপাতালই নেই।"

গ্ৰামের নামটা শুনে চমকে উঠলো চম্পা। বিল্টু বললো-"কি হল মা?"

চম্পা কাঁদো কাঁদো হয়ে বললো-"এখনো ওই গ্ৰামেই আছে তোর বাবার ভিটে।"

বিল্টু আরো উৎসাহিত হয়ে বললো-"তাহলে তুমিও আমার সাথে চলো, নিজেদের বাড়ি থেকে ঘুরে আসবো।"


বহু বছর পর আজ আবার চম্পা ফিরেছে বিল্টুকে সাথে নিয়ে। নিজেদের বাড়ির সামনে এসে দেখলো কয়েকটা ইট ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। কেউ কেউ চিনতে পারলো চম্পাকে। খবর পেয়ে ভিড় জমলো চম্পার ভাঙা বাড়ির সামনে। সবাই ধন্য ধন্য করতে লাগলো চম্পাকে। বললো-'চম্পা তুই সৎ মা হয়েও দেখিয়ে দিলি 'মা' মা ই হয়।"

বিল্টু অবাক হয়ে বললো-"সৎ মা?"

চম্পা বললো-"হ্যাঁ বাবা আজ আর তোর কাছ থেকে কিছু লুকাবো না। দু বছর বয়স যখন তোর,মা মারা যায় তখন তোর। তারপর আমি আসি এ বাড়িতে।"

বিল্টু বলে-"আমি কখনো জানতে চাই না এসব।আমি শুধু জানি তুমি আমার মা শুধু মা। তুমিই আমার সবকিছু।"

মায়ের ভালোবাসা

চম্পার মৃত্যুর পর নিজেদের বাড়ির ধ্বংস স্তুপের উপর  বিল্টু মায়ের স্মৃতির উদ্দেশ্যে তৈরি করেছে একটা হাসপাতাল। হাসপাতালে ঢোকার মুখে তৈরি করেছে তার মায়ের মূর্তি। নীচে লেখা এক মায়ের সংগ্ৰাম করে সন্তান কে প্রতিষ্ঠিত করার কাহিনী।

Comments

Popular posts from this blog

Compare the Best WordPress Hosting Popular for WordPress

ICC Cricket World Cup 2023: A Spectacular Showcase of Cricket Excellence

Eid al-Fitr